মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০২:৫৫ পূর্বাহ্ন

বিলেতে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন নবাগত বাংলাদেশীরাঃ কমিউনিটিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

  • Update Time : বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪
  • ১২ Time View

মাহবুবুল কারীম সুয়েদঃ গত ২ এপ্রিল ফেসবুকে সন্তান কুলে নিয়ে স্ত্রীসহ পারিবারিক ছবি শেয়ার করেছিলেন ঘাতক হাবিবুর রহমান মাসুম।ছবির পাশে ভালোবাসার প্রতীক দিয়ে লিখেছেন “পরিবার”।এই ছবি দেখে কে ভেবেছে যে মাসুমের মনে কত ভয়ংকর খেলা বিরাজ করছে।স্টুডেন্ট ভিসায় আসা মাসুম-কুলসুমা দম্পতির পারিবারিক কলহের পর পুলিশ স্ত্রীকে ১১ মাস বয়সী সন্তানসহ আলাদা করে নিয়ে যায় ব্রাডফোর্ড শহরে।কিন্তু মাসুম সেখানে স্ত্রীর পিছু নিয়ে তাকে ছুরিকাঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করে।পাশে পড়ে থাকে অবুঝ অসহায় শিশুটি।স্ত্রীকে হত্যা করে মাসুম পালিয়ে এসেও শেষ রক্ষা হয়নি।দাতের ব্যাথার চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে গেলে সেখানকার লোকজন তাকে চিনে ফেলে পুলিশে খবর দিলে সে গ্রেফতার হয়।অথচ এই তরুণ দম্পতি কত স্বপ্ন ও আশা নিয়ে এসেছিল বিলেতে।লেখাপড়া শেষ করে ভালো উন্নত জীবনের স্বপ্ন বুনছিল হয়ত মাসুম-কুলসুমা।কিন্তু পারিবারিক কলহ অতঃপর হত্যার মত জঘণ্য ঘটনা শুধু তাদের শেষ করেনি সেই সাথে নিশ্পাপ শিশুটিকেও ঠেলে দিয়েছে এক নির্মম বাস্তবতায়।

তাহমিনা (ছদ্মনাম) সিলেটের ওসমানি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নার্সিংয়ে সম্মান শেষ করে প্রাইভেট হাসপাতালে চাকুরী করতেন সিলেট শহরে।কৃষক বাবা মা ও ছোট ৩ ভাই বোনের সংসারে ২৩ বছর বয়সী তাহমিনা ছিলেন উপার্জনের একমাত্র মানুষ।অন্য কোথাও ভালো চাকুরীর সন্ধানে ছিলেন তিনি।হঠাৎ একদিন তার এক বান্ধবী প্রস্তাব করে বলে যদি তাহমিনা লন্ডনে যেতে চায় টাকার ব্যাবস্থা সে করে দিতে পারবে।বান্ধবীর কথায় তাহমিনা রাজি হয়ে যায়।তো টাকা আসবে কোথা থেকে সেই পন্থা অতি সহজে উপস্থাপন করে বান্ধবী।রাহেলা(ছদ্মনাম) নামের বান্ধবীটির ভাই দেখতে স্মার্ট কিন্তু লেখাপড়া এসএসসি পর্যন্ত।যদি তাহিমনা চায় তাহলে তাদের বিয়ে হবে এবং ইউকে যাবার সম্পুর্ন ব্যায়ভার ছেলে পরিবার বহন করবে।রাহেলা আরো জানায়, লন্ডনে তাহমিনা শুধু নার্সিংয়ের ওপর মাস্টার্স করে নিলেই সব কষ্টের ইতি হবে।ওখানে তাহমিনারা গেলে আর কষ্ট করতে হবেনা।দরিদ্র্য পরিবার থেকে সংগ্রাম করে উঠে আসা তাহমিনা বান্ধবির কথায় রঙ্গিন স্বপ্ন দেখা শুরু করে।একান্ত নিকটজনদের উপস্থিতিতে তাহমিনার পরিবার আকদ সম্পন্ন করে নেয়।আকদের পর তাহমিনার শশুর বাড়ি যাওয়া হয়নি।বরপক্ষ জানায় ভিসা হয়ে গেলে লন্ডন যাওয়ার আগে ঘটা করে কনে ঘরে তুলতে চান।তাহমিনা সরল দিলে তা বিশ্বাস করে ভিসা প্রাপ্তির জন্যে যা যা করা দরকার সব করে নেয়।বিলেতের নামকরা বিশ্বিবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৮ মাসের ভিসা নিয়ে তাহমিনা ও তার স্বামী চলে আসেন বিলেতে।সময় কম অজুহাতে অনুষ্টানও হয়নি এবং শশুর বাড়িও যাওয়া হয়নি।

এখানে এসে তারা স্বামীর বোনের বাসায় উঠেন।তাহমিনা বিলেতে আসার একদিনের মধ্যে বুঝতে পারেন কিছু একটা সবাই লুকাচ্ছে।তাকে থাকতে দেয়া হয় বোনের মেয়ের সাথে।তার স্বামীকে জিজ্ঞ্যেস করলে যা শুনেন তাতে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে তার।তাকে বলা হয়, তোমার টাকা ছিলনা লন্ডন আসা দরকার ছিল।আর স্বামীর টাকা ছিল কিন্তু ছাত্র হয়ে আসার মত যোগ্যতা ছিলনা।কাজে আমি টাকা দিয়েছি তুমি সার্টিফিকেট দিয়েছ।আমার পরিবার রয়েছে দেশে।সপ্তাহখানেকের মধ্যে তুমি ঘর দেখে চলে যেও।তাহমিনা জানান, তিনি এখন বার্মিংহামে মেসে ওঠেছেন।কোন মতে কাজ করে থাকা খাওয়ার খরচ যোগাচ্ছেন।তিনি চোখে পথ দেখছেননা।তার কোন আত্মীয় স্বজন এই দেশে নেই।তাছাড়া স্বামী নাকি ইতিমধ্যে পর্তুগাল চলে গিয়েছে।

রবিউল বিয়ে করে স্ত্রী নিয়ে এসেছিলেন কেয়ার ভিসায়।থাকতেন পু্র্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রীন এলাকায়।লন্ডনে আসার মাস তিনেকের মাথায় তিনি আবিস্কার করেন স্ত্রীর দেশে কারো সাথে সম্পর্ক রয়েছে।এ নিয়ে একরাতে কথা কাটাকাটির পর তিনি ঘুমিয়ে গেলে মধ্যরাতে কলিং বেলের শব্দে তার ঘুম ভাঙ্গে।দরজা খুলে দেখেন পুলিশ দাড়িয়ে।থানায় নিয়ে তাকে জানানো হয় তার স্ত্রী পুলিশের কাছে স্বামী কতৃক ধর্ষনের অভিযোগ করেছেন।সপ্তাহ খানেক হাজত খেটে জামিনে বেরিয়ে রবিউল দিশেহারা অবস্থায় আছেন।তিনি জানান, একটি সিএনজি ও কিছু দামী জমি বিক্রি করে ৩০ লাখ টাকার বিনিময়ে দালালের মাধ্যমে তারা লন্ডনে এসেছিলেন।এখন তিনি কি করবেন তা নিজে জানেননা।

এভাবে বিলেতে বাঙ্গালি কমিউনিটিতে নানা অঘটন ঘটেই চলছে প্রতিদিন।কেউ কন্ট্রাক্ট বিয়েতে এসে স্ত্রী রেখে পালিয়ে যাওয়া, কলহ বিবাদে পুলিশ কেস করা, থাকা খাওয়ার জন্যে নানা অনৈতিকতায় জড়িয়ে পড়াসহ বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলছে।এইসব নিয়ে কমিউনিটিতে চলছে নানা মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কমিউনিটির নানা দিক নিয়ে কাজ করেন এমন অনেকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের এখানে ৪র্থ প্রজন্ম চলছে।নানা চড়াই উৎরাই পার করে আজকের এই অবস্থান।সেখানে এই হত্যা, ফেইক বিয়ে, পুলিশ কেস, ভুয়া জব কন্ট্রাক্ট ইত্যাদির কারনে দিনে দিনে আমাদের কমিউনিটির সুনাম বিনষ্ট হচ্ছে।

চলমান এইসব বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে বিলেতের সুপরিচিত ওয়েস্ট মিনিস্টার ল চেম্বারের কর্ণধার ব্যারিষ্টার আহমেদ এ মালিক বলেন “বিলেতে চলে আসা কমিউনিটির ইমেজ দিনে দিনে সংকটাপন্ন হচ্ছে।বিপুল সংখ্যক নবাগতদের অনেকেই এখানে কুলিয়ে উঠতে না পেরে বাকা পথে ইউরোপে পাড়ি জমান।অনেকে নানাভাবে এখানে ঠিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যান।কিন্তু সফল খুব কম মানুষই হন।”

কমিউনিটি একটিভিস্ট জায়েদ মানিক চৌঃ জানান ভূয়া বিয়ের যে দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে তাতে করে একদিকে যেমন দেশের সম্মান নষ্ট হয় অপরদিকে আগতরাও বিয়ের মত পারিবারিক বন্ধনকে নানা বিতর্কিত কান্ডের মাধ্যমে সমালোচিত করছেন।তিনি বলেন, এখানকার প্রজন্ম এইসব দেখে দেশ সম্পর্কে এক ধরনের বিরুপ ধারনা পাচ্ছে।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published.

More News Of This Category