শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৩৯ অপরাহ্ন

বৃটেনের নির্বাচন নিয়ে যতকথাঃ মাহবুবুল কারীম সুয়েদ

  • আপডেট : শনিবার, ৬ জুলাই, ২০২৪
  • ৭৫ Time View

১-বৃটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে লম্বা সময় দেশ শাসন করেছে টোরি পার্টি।এবারেও টানা ১৪ বছরের শাসন শেষে গতকাল মাত্র ১৩১টি সিট পেয়ে প্রধান বিরোধীদলের ভুমিকায় নাম লিখিয়েছে দলটি।২০১৯এর প্রাপ্ত সিট থেকে ২৫০টি কমেছে।তারা যে হারবে তা প্রধানমন্ত্রি মিঃ সোনাকের নির্বাচনী সভায় প্রদত্ত ভাষন থেকেই বুঝা যাচ্ছিল।সে বারবার বলছিল “আমরা লেবারকে একক মেজরিটি দেয়া থেকে বিরত থাকি”! বৃটেনের ইতিহাসে প্রথম অ-শেতাঙ্গ প্রধানমন্ত্রি ধনকুবের মিঃ সোনাক টোরির ইতিহাসেও “সেরা অপদার্থ” বিবেচনায় থাকবেন।মানুষ কনজার্ভেটিবের ওপর বিরক্ত ছিল মুলত ব্রেকজিট ইস্যু থেকে নিয়ে নানা কান্ডে।জীবন ধারনের যে পরিমান খরচ বেড়েছে তাতে দেশের মানুষ হিমশিম খাচ্ছে।তাছাড়া কয়েক বছরের ব্যাবধানে দলীয়ভাবে একের পর এক প্রধানমন্ত্রি পরিবর্তনকেও দেশের মানুষ ভালো চোখে নেয়নি।গতকালের নির্বাচন যেন ছিল সব ক্ষোভের নিরব প্রতিবাদ।

২-১৯৯৭র পর লেবার পার্টি এবার একক এত বিশাল মেজরিটি পেয়েছে।লেবারের অজনপ্রিয় ও বিতর্কিত নেতা মিঃ কিয়ার স্টারমার দলীয় সিস্টেমে নেতৃত্বে চলে এলেও নির্বাচনকালীন তার বক্তব্য বিবৃতি এবং সেইসাথে যুদ্ব,মানবাধিকার,শিশু হত্যা নিয়ে তার নিন্দাজনক বক্তৃতার পরও টোরির উপর চরম বিরক্ত মানুষ যারা জীবনে লেবারকে ভোট দেয়নি তারাও এবার লেবারকে ভোট দিয়েছে।এই ভোট প্রাপ্তি লেবারের কোন আলাদা পলিসির কারনে নয় বরং পরিবর্তনে বিশ্বাসী মানুষের চাপিয়ে দেয়া দায়িত্ব বলা যায়।তাছাড়া নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের চাপাক্ষোভ ও ট্যাক্সের চাপে পিষ্ট টাকাওয়ালাদের ভুমিকা কাজ করেছে।অভিনন্দন লেবারকে এবং পুননির্বাচিত চার বৃটিশ বাঙ্গালি কন্যাকে।আশা করি আমরা এবার মন্ত্রি পদে বাঙালিকে দেখব।

৩-আমার দল লিবডেম।জাতীয়ভাবে ৩য় বৃহত্তর রাজনৈতিক দল।২০১০র নির্বাচনে কনজারভেটিব লিবডেমের সাথে কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করতে হয়েছিল এবং দলনেতা মিঃ নিক ক্লেগ উপপ্রধানমন্ত্রি হয়েছিলেন।কিন্তু ছাত্র বেতন সংক্রান্ত রাজনৈতিক ভুলের খেসারত হিসেবে লিবডেনম অনেকটা ব্যাকফুটে চলে যায়।একলাফে আসন সংখ্যা কমে আসে।যেখানে ২০১০ সালে পেয়েছিল ৫৭টি আসন সেখানে ভুল সিদ্বান্তের কারনে ২০১৯ সালে পেয়েছিল মাত্র ১১টি আসন!৩য় স্থান থেকে আসন বিবেচনায় স্কটিশ পার্টিরও পেছনে পড়ে যায়।কিন্তু স্থানীয়ভাবে অর্থ্যাৎ সিটি ও টাউন কাউন্সিল এলাকাগুলোতে লিবডেম জনপ্রিয় ছিল।২০২৩র নির্বাচনে লিবডেমের ঝুড়িতে বেশ কিছু কাউন্সিলের পু্র্ন নিয়ন্ত্রনসহ বেশিরভাগ জায়গায় স্থানীয় সরকারের বিরোধীদলের আসনে জায়গা করে নেয় লিবডেম।আমার শহরসহ আশেপাশের প্রায় সব শহরে লিবডেম স্থানীয় কাউন্সিলের হয় প্রধান বিরোধীদল অথবা নিয়ন্ত্রকের ভুমিকায় রয়েছে।এবার লিবডেম নেতা স্যার ডেবির নেতৃত্বে দল ৭১টি আসন পেয়ে জাতীয় রাজনীতিতে আবারো ৩য় স্থান দখল করেছে সেই সাথে জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালি হিসেবে ভুমিকা রাখার সুযোগ পেয়েছে।

৪-দল থেকে “হিসাব পর্যবেক্ষকের অফিসিয়াল” দায়িত্ব প্রাপ্ত হিসেবে গতরাত ৩টা পর্যন্ত ছিলাম ভোট গননা কেন্দ্রে।বিশাল হলরুমে বিভিন্ন দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষ থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত কাউন্টিং পর্যবেক্ষক, প্রার্থী, শুভানুধ্যায়ী ও সাংবাদিকদের পদচারনায় ভোররাত ৩টা পর্যন্ত গমগম করছিল গোটা হলরুম।আইনশৃংখলা বাহিনী কাউন্সিল প্রদত্ত আইডি কার্ড চেক করে করে দায়িত্বপ্রাপ্তদের ভেতরে ঢুকাচ্ছিল।লুটনের এক আসনে লেবার প্রার্থীর প্রাপ্তভোটের বিপরীতে দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর ভোট জড়ো করলে বেশি হয়।যদি সেখানে আতিক মালিক অথবা ইয়াসিনদের একজন প্রার্থী হত তাইলে লেবারের নিশ্চিত পরাজয় ছিল।কিন্তু বিভাজন আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকানো।লেবারের বিপরীতে একক কোন সিদ্বান্তে আসার মত মানসিকতার মানুষ ছিলনা।বিশেষ করে আমাকে আশাহত করে স্থানীয় বাংলাদেশিদের অবস্থান।প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশিদের অবস্থান থাকার পরও জাতীয় নির্বাচনে চোখে পড়ার মত ভুমিকা ছিলনা আমাদের।সেই তুলনায় পাকিস্তানিদের লুটনে পলিটিক্যাল ডিসিশান মেকিংয়ে ভুমিকা ব্যাপক।পিছিয়ে পড়া আমাদের ঐক্যবদ্ব নেতৃত্বই কেবল পারবে সামষ্টিক নেতৃত্বের আসনে বসাতে।

৫-বিলেতের বাংগালীদের রাজনীতির আতুড়ঘর টাওয়ার হেমলেটসে গিয়েছিলাম নির্বাচনের আগের দিন।মন থেকে চেয়েছি আজমল মাশরুরের বিজয়।হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর মাত্র হাজার খানেক ভোটে তার পরাজয় ব্যাক্তিগতভাবে হতাশ করলেও প্রথম বাঙ্গালি কন্যা রোশনারার এবারকার বিজয় বাঙ্গালির ইতিহাসে প্রথমবারের মত মন্ত্রিত্বের গৌরব অর্জনের পথ খুলে দেবে বলে সবার মত।যদি রাবিনা খানকে কমিউনিটির সিনিয়র নেতৃবৃন্দ বুঝাতে সক্ষম হতেন তাইলে আজমলের নিশ্চিত জয় ও লেবারের নিশ্চিত পরাজয় ছিল।আজমল পারতেন ২০১০ সালে এমপি হতে যদি না ইস্ট লন্ডনওয়ালাদের সমর্থন তৎকালিন সময়ে অন্যদের প্রতি না থাকত।লেবারের সাবেক দলনেতা এবং দেশের সবচেয়ে ব্যাক্তি হিসেবে জনপ্রিয় নেতা জেরেমি করবিন স্পষ্টবাদীতার কারনে দলে কোনটাসা হয়ে এবার মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছিলেন।৪০ বছর ধরে নির্বাচিত হওয়া আসনে এবার নিজ দলের বিপক্ষে লড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি ইতিহাস গড়েছেন।

৬-বৃটেনের রাজনীতির দুই আলোচিত নাম নাইজেল ফারাজ ও জর্জ গ্যালওয়ে।জর্জ ইরাক ইস্যু থেকে পেলেস্টাইন নিয়ে রাজনীতি করেন।গ্লাসগো থেকে শুরু করে বিভিন্ন আসনে জর্জ সাংসদ হয় অতিথি হিসেবে।মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ব হওয়া মানে জর্জের কোন মুসলিম এরিয়া থেকে এমপি হওয়া এবং নতুন পার্টি গঠন করে প্রার্থী দেয়াটা অবধারিত!মাত্র মাস দুয়েক আগে জর্জ মুসলিম অধ্যুষিত রচডেল থেকে এমপি হন এবং এবারের নির্বাচনে বিভিন্ন জায়গায় প্রার্থীও দেন।এবারাকার দল ছিল ওয়ার্কার্স পার্টি।নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়ে জর্জ হেরেছেন।তবে যুদ্ব বিরোধী তার দরাজ গলার প্রতিবাদ অব্যাহত থাকবে এবং তিনিও নতুন নতুন দল গড়ে সারা দেশে লেবারের ভোট নষ্টে ভুমিকা রাখবেন এটা ধরে নেয়া যায়।অপরদিকে ৮বার ফেল করে প্রথমবারের মত সংসদে আসা কট্ররপন্থী নেতা নাইজেল ফারাজের নির্বাচন পুর্ব ভাষন ও হম্বিতম্বি দেখে মনে হচ্ছিল তার দল ৩য় স্থানে চলে আসছে।জরিপও অনেকটা এমন পুর্বাভাস দিচ্ছিল।ইমিগ্র্যান্ট বিরোধী তার বক্তৃতা বিবৃতি দেখে দেখে অনেক শেতাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকায় তার দল রিফর্ম ইউকের লোকেরা উল্লেখযোগ্য ভোট পেলেও মাত্র দুই আসন পেয়েছে ফারাজের দল।সাধারন মানুষ যে হিংসুক ও কট্ররবাদকে পছন্দ করেনা তার বার্তা দিয়েছে।ফারাজ ঝানু বক্তা।বৃটেনের নির্বাচনে ৮বার ফেল করলেও ইউরোপীয়ান সংসদ তার দরাজ গলার গরম ভাষনে গরম থাকত।এবার হয়ত হাউজ অফ কমন্সে ফারাজ আগুন ঝরাবেন তবে তা হোক বৃটেনের ঐতিহ্যের লালনে এই প্রত্যাশা করি।

লেখকঃ মাহবুবুল কারীম সুয়েদ
এক্সিকিউটিব মেম্বার, লুটন লিবডেম ইউকে।
ট্রেজারার, ইউকে-বাংলা প্রেসক্লাব।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর