ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে দূরের দৃশ্য দেখতে কার না মন চায়! টগবগে তরুণ আক্তার হোসেনও একদিন ট্রেনের দরজায় বসে বাইরের পরিবেশ উপভোগ করছিলেন। কিন্তু সেই আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। হঠাৎ দরজা থেকে পড়ে যান আক্তার। প্রাণে বেঁচে গেলেও পা হারাতে হয়। দুই পা–ই ঊরু পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়।
ঘটনাটি প্রায় চার দশক আগের। এখন আক্তার হোসেনের বয়স ৫৫ বছর। দুই পা হারানোর পর আক্তার ভেবেছিলেন ভিক্ষা করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া ছাড়া বুঝি আর উপায় নেই! তবে সেখানেই থেমে যাননি তিনি। দুই পা কেড়ে নেওয়া ট্রেনেই খুঁজে নিয়েছেন বেঁচে থাকার অবলম্বন। বগিতে বগিতে জুতা পলিশ করে মনের জোরেই এগিয়ে চলছেন বাকি পথটা।
৫ নভেম্বর জামালপুর থেকে ঢাকাগামী আন্তনগর তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনে আক্তার হোসেনকে জুতা পলিশ করতে দেখা যায়। সেখানেই কথায় কথায় জানা যায়, তাঁর বাড়ি জামালপুর সদর উপজেলার নরুন্দি ইউনিয়নের আড়ালিয়া উত্তর পাড়া গ্রামে। তাঁর দুই ছেলে। স্ত্রী নুরজাহান তাঁকে সার্বিক সহযোগিতা করেন। পঙ্গু জীবন নিয়ে সন্তানকে বড় করলেও বড় ছেলে এখন স্ত্রীকে নিয়ে শহরে থাকেন। ভরণপোষণ দেন না। এ নিয়ে তাঁর কিছুটা আক্ষেপ রয়েছে।
আক্তারের ঊরুতে প্লাস্টিকের কভার লাগানো রয়েছে। দুই হাতের ওপর ভর করে ট্রেনের এক বগি থেকে আরেক বগিতে ছুটে চলেন, জুতা পলিশ করেন। প্রতিদিন ভোর পাঁচটা থেকে রাত পর্যন্ত যুদ্ধ করে তাঁর আয় হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। সেই আয়ে চলে সংসার। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় জুতা পলিশের আয়ে চলতে কষ্টের কথা জানালেন আক্তার হোসেন, তবে অভিযোগ নেই।দুর্ঘটনার দিনের ঘটনা এখনো উজ্জ্বল আক্তারের স্মৃতিতে। তিনি বলেন, ছোট থেকেই ট্রেনে উঠতে ভালো লাগত। দরজায় বসে ট্রেন থেকে দূরের দৃশ্য দেখতে খুব ভালো লাগত। প্রায় ৪০ বছর আগে একদিন ময়মনসিংহ থেকে আসার সময় ট্রেনের দরজায় বসে বাইরের দৃশ্য দেখছিলেন। কীভাবে যেন দরজা থেকে পড়ে যান। এরপর জ্ঞান ফিরে দেখেন দুই পায়ের ঊরু পর্যন্ত কাটা। এতে সব এলোমেলো হয়ে যায়।
আক্তার হোসেন বলেন, ‘প্রথম দিকে পরিবারের সবাই সাহস দিলেও ধীরে ধীরে সবার কাছে বোঝা হয়ে যাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম ভিক্ষা করে বাকি জীবন কাটিয়ে দেওয়া ছাড়া বুঝি আর উপায় নেই! কিন্তু আত্মসম্মানে লাগছিল। পরে ঠিক করলাম, যে ট্রেন আমাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। সেই ট্রেনে জুতা পলিশ করব। এরপর কোমর পর্যন্ত প্লাস্টিকের কভার লাগিয়ে জুতা পলিশ শুরু করি। এর পর থেকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এভাবে ৩৫ বছর চলে যাচ্ছে।’
পঙ্গুত্ব মেনে নিয়েই আক্তারের জীবনসঙ্গী হন নুরজাহান বেগম। আক্তার বলেন, ‘তাঁর সাহস আর সহযোগিতায় আমি তিন সন্তানের জনক। সবার বড় এক ছেলে। একটি মেয়ে ছিল, মারা গেছে। ছোটবেলায় ছেলের মধ্যে স্বপ্ন দেখতাম। সে বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু সেটা হয়নি। ছেলে বিয়ে করে, বউ নিয়ে শহরে থাকে। অথচ তাঁর এক সন্তানকে আমি লেখাপড়া ও লালনপালন করে যাচ্ছি। এই বয়সেই বগিতে বগিতে ছুটে চলা, কিছুটা ক্লান্ত লাগে। তবে উপায় নেই। আমি ছুটে না চলতে পারলে আমার সংসার চলবে কীভাবে?’
ট্রেনের মধ্যে অনেকেই আক্তারের অবস্থা দেখে জুতা পলিশ করিয়ে নেন। তবে যে আয় হয়, তাতে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। সরকারের প্রতিবন্ধী ভাতা পান। আক্তার বলছিলেন, একটা সময় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় দিয়ে পুরো সংসার চলাতে সমস্যা হতো না। এখন তো সব জিনিসের দাম বেশি। এখন ৫০০ টাকা আয় করেও সংসার চলাতে হিমশিম খেতে হয়। এভাবে জীবন চালিয়ে নিচ্ছেন। তবে আর কত দিন পারবেন তিনি জানেন না।
আক্তার বলেন, ‘সরকারের বা অন্য কারও সহযোগিতা পেলে নিজের ওপর থেকে চাপ কিছুটা কমত। এলাকায় যদি কোনো দোকান করতে পারতাম। তাহলেও কষ্ট অনেকটাই কমত।’
আক্তারকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন নরুন্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. লুৎফর রহমান। যোগাযোগ করা হলে বলেন, ‘ট্রেনের জুতা পলিশ করা আক্তারকে চিনি। তবে কখনো তিনি কোনো ধরনের সাহায্যের জন্য পরিষদে আসেননি। তাঁকে সামাজিক কর্মসূচির আওতায় আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।