মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫, ১০:৪১ অপরাহ্ন

ইউনুস সফল, ইউনুস বিফল

  • আপডেট : মঙ্গলবার, ৩ জুন, ২০২৫
  • ১ Time View

বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন মোড় ঘোরানো সময় খুব কমই এসেছে, যেখানে একটি সমাজ ভেঙে পড়ার একদম দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল এবং সেখান থেকে কোনও একজন ব্যক্তির নেতৃত্বে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ঠিক তেমনি একটি সময় এখন। আর এই সময়ের কেন্দ্রে যে মানুষটি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি হচ্ছেন নোবেল লরিয়েট, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস। তার নেতৃত্ব, সংযম এবং সংকট মোকাবেলার অনন্য ধরণ দেশকে নতুন সম্ভাবনার পথে নিয়ে যাচ্ছে।

ক্ষমতা নয়, দায়িত্বের মানসিকতা

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার সূত্র ধরে সাম্প্রতিক সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের টানাপড়েন দেখে অনেকেই আতঙ্কে ছিলেন, মনে হয়েছিল ২০০৭-এর পুনরাবৃত্তি বুঝি আবার সামনে। কিন্তু সেখানে প্রফেসর ইউনুসের সরকার যে প্রজ্ঞা ও ধৈর্য দেখিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। সেনাপ্রধানের বক্তব্যের পর উপদেষ্টা পরিষদের স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেওয়া যে ‘সরকারের উপর সরকার চলতে দেব না’—এটিই ছিল গুরুত্বপূর্ণ মোড়। সবচেয়ে বড় কথা, ইউনুসের স্পষ্ট বার্তা—“যদি কেউ চাপ দেয়, আমি দায়িত্ব ছেড়ে দেব”—এই এক বাক্যে পুরো পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। যেখানে আমরা জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকার সংস্কৃতি দেখেছি, সেখানে এমন উচ্চারণ যেন এক গ্লাস ঠান্ডা জল।

জাতীয় ঐকমত্যের পথে

গতকাল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা এক প্ল্যাটফর্মে এসে আলোচনা করেছেন। আদর্শে পার্থক্য থাকলেও, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে প্রায় সকলেই এক কাতারে এসেছেন। এটি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক নতুন ধারা।

এই ঐকমত্যের মধ্যে দিয়ে ‘জুলাই সনদ’-এর পথ তৈরি হচ্ছে, যা সকল দলের স্বাক্ষরিত একটি যুগান্তকারী সাংবিধানিক রূপরেখা হতে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সংস্কার এবং নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কারের এমন ঐতিহাসিক সুযোগ খুব কমই আসে।

ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের বিজয়

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর, তার দল আওয়ামী লীগ কার্যত নিষিদ্ধ হয়েছে। ছাত্র আন্দোলনের ঢেউয়ে পালিয়ে যাওয়া হাসিনা, রেহানা এবং অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কোনও গণতান্ত্রিক অন্তর্বর্তী সরকার দলনিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, একজন অর্থনীতিবিদ, শান্তির প্রতীক ড. ইউনুস। তার নেতৃত্বে দেশ আজ সামগ্রিক পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে।

অর্থনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সাফল্য

ইউনুস সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হয়েছে। বিনিয়োগ বাড়াতে নানা উদ্যোগ, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতি দমন, যোগ্য ব্যক্তিদের পদায়ন, বিদেশি বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করে প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানো—সব কিছুই দেশের দীর্ঘমেয়াদী লাভের পথ তৈরি করছে।

তিনি প্রমাণ করছেন, দলীয় রাজনীতির বাইরে থেকেও এক জনদরদী, দক্ষ ও নীতিবান সরকার কিভাবে চলতে পারে।

মানবাধিকার বিচার ও জাতিসংঘের রিপোর্ট

হাসিনা সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, এই বিচার হচ্ছে সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচারিত – গণদর্শনযোগ্য একটি ট্রায়াল। আন্তর্জাতিক মহলে এই নজিরবিহীন উদ্যোগ প্রশংসা কুড়িয়েছে।

জাতিসংঘ কর্তৃক প্রকাশিত ‘জুলাই গণহত্যা’ সম্পর্কিত তদন্ত প্রতিবেদন প্রমাণ করেছে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এবং তার ঘনিষ্ঠরা মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত ছিলেন। তাদের সম্পদ জব্দ, বিচার প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক অপমৃত্যু – এসবই একটি যুগের অবসান এবং আরেকটি যুগের সূচনা ঘটাচ্ছে।

সামনে নির্বাচনের অপেক্ষায়

সবশেষে প্রশ্ন ওঠে – ইউনুস কি তার দায়িত্ব সফলভাবে শেষ করতে পারবেন? আমাদের প্রত্যাশা, তিনি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে জাতিকে একটি টেকসই ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে দেবেন।

ড. ইউনুস হয়তো চিরস্থায়ী রাজনীতিবিদ নন, কিন্তু এই পড়ন্ত বয়সে এসেও তিনি দায়িত্ব নিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছেন, একজন সৎ, বিবেকবান, আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ কিভাবে একটি বিপর্যস্ত জাতিকে আশা দিতে পারেন।

জুলাই সনদ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার যে লক্ষ্য, তার সফল বাস্তবায়নই নির্ধারণ করবে ইউনুস সফল, না বিফল। এখন পর্যন্ত দৃশ্যপটে তিনি সফলতার পথেই এগোচ্ছেন।

লেখকঃ মাহবুবুল কারীম সুয়েদ
যুক্তরাজ্য প্রবাসী কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
mksuyed@gmail.com

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর