শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৪৩ অপরাহ্ন

মরমি সাধক হাছন রাজার বাড়ি ধ্বংসের পথে

  • আপডেট : সোমবার, ২০ জানুয়ারী, ২০২৫
  • ১৩ Time View

‍‍`কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরই মাঝার, ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর, অয়না দিয়া চাইয় দেখি পাকনা চুল আমার। লোকে বলে বলে রে ঘরবাড়ি ভালা না আমার’ সবার হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নেওয়া এই কালজয়ী গানের স্রষ্টা মরমি কবি দেওয়ান হাছন রাজা।

সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার রামাপাশায় অবস্থিত হাছন রাজার পৈতৃক বাড়িটির সঙ্গে অতীত স্থাপত্যশৈলীর অনেক স্মৃতি জড়িত। ঐতিহাসিক এই বাড়িটি রাষ্ট্রীয় সম্পদও বটে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যবাহী এই বাড়িটি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। কিন্তু হাছন রাজার এই বাড়িটি রক্ষা করতে কেউ উদ্যোগ নিচ্ছে না, এমনটি রাষ্ট্রীয়ভাবেও কোনো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবেই এই বাড়িটি রক্ষা করা বা রক্ষণাবেক্ষণ করা অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করি। সংস্কারের মাধ্যমে বাড়িটি রক্ষা করলে দর্শনীয় স্থান হিসেবেও পরিণত করা সম্ভব, যা পরবর্তী সময়ে দেশ-বিদেশের দর্শকদের দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিগণিত হবে এবং পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত হবে বাড়িটি।

হাছন রাজার তাঁর জীবদ্দশায় লিখেছিলেন, ‘কানার হাতে সোনা দিলে লাল-ধলা চিনবে না।’ ‍‍`মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়া রে, কান্দে হাছন রাজার মন মইনা রে’ গানের এ কথাগুলো প্রতিটি মানুষের অন্তরে গেঁথে আছে আজও। গানের কথা ও সুর হাছন রাজার জীবনবোধের যে সম্মিলন, তা প্রতেকের মন ছুঁয়ে যায়।

জানা গেছে, আজ থেকে বহু বছর আগে, হাছন রাজার বাবা দেওয়ান আলী রাজা সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর ধারে প্রতাপশালী দাপুটে জমিদার বৈরাগ্য সাধনে মুক্তির পথ বেছে নিয়েছিলেন। তিনি একজন প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন। তাঁর আওতায় ছিল দুই স্টেটের জমিদারি । যার একটি বিশ্বনাথের রামপাশা ও আরেকটি সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে। রামপাশার জমিদারি দেখাশোনা করতেন তাঁর বড় ভাই উবাইদুর রাজা চৌধুরী।

হাছন রাজার যৌবনের প্রারম্ভেই তাঁর বাবা ও একমাত্র বড় ভাইকে হারান। হাছন রাজার বয়স যখন মাত্র ১৫ বছর, তখন তাঁর ওপর অর্পিত হয় দুই স্টেটের জমিদারি। এখনো সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, বিশ্বনাথ, সুনামগঞ্জ, লক্ষণশ্রীসহ বিভিন্ন এলাকায় তাঁর আধিপত্যের সাক্ষর বিদ্যমান। হাছন রাজার রাজকীয় জমিদারি থাকা সত্ত্বেও তিনি গড়ে তোলেননি কোনো রাজপ্রাসাদ। বর্তমানে যেটুকু বিদ্যমান আছে, তাও ধ্বংসের পথে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হাছন রাজার রামপাশার দুতলা বাড়িটির ধ্বংসাবশেষ ছাড়া তেমন কোনো স্মৃতি নেই। যা আছে তাতেও বাসা বেঁধেছে পোকামাকড়। আর আবৃত্ত করে নিয়েছে  পরগাছা। ঘরের মেঝেতে পশুপাখির মলমূত্রও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে যত্রতত্র। খসে খসে পড়ছে দেয়ালের ইট-কাঠ-পাথর। ‍‍`কী ঘর বানামু আমি শূন্যেরও মাঝার‍‍` সুরের পরিণতি আজ সত্যি করুণ। এমনি অযতœ-অবহেলায় ধীরে ধীরে মাটির সঙ্গে বিলীন হয়ে যাচ্ছে তাঁর স্মৃতি বিজড়িত সেই বাড়িটি। এখনো সময় আছে এই বাড়িটি রক্ষা করার। না হলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে, কেন ঐতিহ্যবাহী সুরের জাদুকরী সুরের স্মৃতিচিহ্নটুকু রক্ষা করতে পারলাম না আমরা ভক্তকুল। আর এটা হবে তার ভক্তকুলসহ জাতির জন্য দুঃখজনক অধ্যায়।

স্থানীয়রা জানান, উদ্যোগ নিয়ে বাড়িটি কিছুটা সংস্কার আর সংরক্ষণ করলেই বাড়িটি হয়ে উঠত বিশ্বনাথ উপজেলার একমাত্র পর্যটন স্পট। অনেক আগে থেকেই এ দাবি করে আসছিলেন হাছন রাজার ভক্তবৃন্দ। কয়েকবার উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবে করা সম্ভভ হয়নি কোনো অদৃশ্য কারণে। বর্তমান সরকারের কাছে জোর দাবি, ঐতিহ্যবাহী এই বাড়িটি যেকোনো মূল্যে রক্ষা করা হোক। তাহলেই ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবে হাছন রাজার এই স্মৃতিচিহ্ন। এটাই দেশবাসীসহ ভক্তকুলের প্রাণের দাবি।

বাড়ির দায়িত্বে থাকা পংকি মিয়া বলেন, কয়েকবার পরিবার থেকে বাড়িটি সংস্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে আর হয়ে উঠেনি। তাঁর বংশধররা প্রতি ঈদে বাড়িতে আসেন। এলাকার অসহায়দের মাঝে বিভিন্ন সামগ্রী বিতরণ করেন। কিন্তু তারাও কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না।

স্থানীয় ব্যবসায়ী আবু সুফিয়ান বলেন, হাছন রাজা মরমি সাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য ইতিহাস। তাঁর স্মৃতিটুকু বাঁচিয়ে রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। পরিবার থেকে না হলেও সরকারি উদ্যোগে এই বাড়িটি সংরক্ষণ ও সংস্কার করা এখন সময়ের দাবি।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর