গতকাল দ্বিতীয়বারের মতো সাফ জয় করেছে বাংলাদেশ মেয়ে ফুটবল দল। ।
এই জয় দেশের জন্য নিঃসন্দেহে গৌরবের। দেশের মধ্যে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী থেকে উঠে এসেছে আমাদের অনেক নারী ফুটবলার। প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁরা অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলেও খেলার প্রতি তাঁদের অদম্য ইচ্ছা শক্তি তাদেরকে এই জয় এনে দিয়েছে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের এই সময়ে অনেকের কাছেই বিশেষ করে বড় বড় সার্টিফিকেট ওয়ালা ভদ্রলোকদের কাছে নারীদের এই জয় নিছক অবহেলার।
অথচ ধরুন এই জয় অর্জন করেছে দেশের ছেলে ক্রিকেটাররা বা দেশের ছেলে ফুটবলাররা। তাহলে কিন্তু আমরা অনেকে তাঁদের সাধুবাদ এবং শুভেচ্ছা জানাতাম। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে বড় বড় করে অভিনন্দন পোষ্ট দিতাম।
কিন্তু যখনই দেখছি নারীদের বড় অর্জন আমরা কেন জানি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম …
নারী কবিতায় লিখেছেন ।
“সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
ছোট বেলা থেকে নজরুল রবীন্দ্রনাথ পড়া মস্তিষ্কগুলো। সমাজে এতো বড় বড় ডিগ্রিধারি মানুষগুলো তাঁরা কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনা নারীরা ঘরের বাহিরে বা বিশ্বকে জয় করার ক্ষমতা রাখতে পারে।
আমরা কথায় কথায় উদাহরণ টেনে উন্নত বিশ্বের সাথে তুলনা করি । উন্নত দেশে এটা করা হয় ওইটা করা হয়।
আমরা কি কখনো নিজেরা উন্নত বিশ্বের চিন্তা এবং চেতনার সাথে নিজেদের মিলিয়ে দেখেছি ??
উন্নত দেশগুলোতে একটি মেয়ে শিশুকে কিভাবে বা কি চোখে দেখা হয়, এর অনেক উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে।
সেই দেশগুলোতে ছেলে মেয়ের মাঝে কোন পার্থক্য করা হয় না।
মেয়েদের কে তাঁরা একজন মানুষ হিসেবে ভাবে, মেয়ে নয় ।।
ব্যাক্তিগত ভাবে আমি ফুটবল খেলাকে বেশ পছন্দ করি এবং সময় পেলে নিজেও খেলি।
গত সাঁত বছরের জার্মান মূলকের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। জার্মানির প্রত্যন্ত গ্রামের স্পোর্টস ক্লাবগুলোতে ফুটবল/হকি সহ সকল খেলাতেই মেয়েদের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়।
এই সপ্তাহের শুরুতে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বর্ষসেরা ফুটবলারদের মহাআসর বসেছিলো। বিশ্বের নামীদামী ক্লাবগুলোতেও নারীদের আধিপত্য কম নয়।
এমনকি নারীরাও পুরুষদের সাথে ব্যালন ডি’অর জিতে নিচ্ছে।
২০২৪ সালে প্রযুক্তির উচ্চশিখরে বসে বিশ্ব যখন এগিয়ে যাচ্ছে সারাবিশ্বের নারীরা যখন তাঁদের নিজ নিজ ক্রিয়াঙ্গনে উন্নতি করে যাচ্ছে।
তখন আমরা নারীদের ঘরে বাহিরে কাজ করতে বা খেলাধুলায় অংশ নিতে নিরুৎসাহি করছি।
কিন্তু কেন ?
দেশ স্বাধীন হলো ৫৩ বছর। স্বাধীনতার পরও দেশের শিক্ষিত সমাজের মধ্যেও নারীদের প্রতি এই ধরনের অবহেলা ব্যাপক ভাবে দেখা যায়।
আমাদের দেশের অনেকে আবার নারীদের খেলাধুলা করা কে ধর্মীয় বাঁধা মনে করে। একটি গোষ্ঠী প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে কিভাবে নারীদের শুদুমাত্র ঘরের আসবাব বানিয়ে রাখা যায়।
কিন্তু আমরা দেখছি বর্তমান আরব বিশ্বেও নারীরা নিয়মিত খেলায় সাফল্য করে যাচ্ছে । মিশরের নারী ফুটবলাররা রীতিমতো লীগ দাপিয়ে বেরাচ্ছে।
গত ৫ বছরে সৌদি আররে নারী ফুটবলারদের সংখ্যা শূন্য থেকে পঞ্চাশ হাজার।
তাঁরা তাঁদের নারী ফুটবলারদের উন্নতির জন্য চালু করেছে পেশাদার লিগ। আল হিলাল, আল নাসর, আল ইত্তিহাদসহ আট দল নিয়ে ২০২০ সালে শুরু এই লিগের।
গত ৫৩ বছরে আমরা কি বাংলাদেশে কোন নারী ফুটবল লীগ করতে পেরেছি ?
ফেডারশনের প্র্যাকটিস এবং সাফ ছাড়া নারীদের তেমন কোন খেলারও আয়োজন করা হয় না।
এই লেখা লেখার সময় একটি সংবাদ পেলাম।
“টানা দুইবার সাফ জিতলেন অথচ টানা দুই মাসের বেতন পান না নারী ফুটবলাররা”
সুত্রঃ ডেইলি ইস্টার বাংলা।
নারীদের খেলাধুলায় আগ্রহ তৈরি করা শুধু যে সরকারের কাজ তা নয়।
দেশের আপামর মানুষের মধ্যে মস্তিস্কগত পরিবর্তন আনতে হবে। একজন ছেলে যা করতে পারে একজন মেয়েও সেটা করতে পারে।
তথাকথিত ধর্মের বেড়াজাল ছিঁড়ে ফেলে নারীদের সামনে তুলে ধরতে হবে বড় হওয়ার স্বপ্ন ।
আমাদের মেয়েদের শোনাতে হবে সাবিনা এবং ঋতুপর্ণাদের গল্প।
পরিশেষে কাজী নজরুলের নারী কবিতার শেষের লাইনটি দিয়ে শেষ করছি।
“সেদিন সুদূর নয়-
যে দিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীর ও জয়”।
শ্রাবণ রহমান ।
কলামিস্ট , হামবুর্গ জার্মানি।
rabdur1000@gmail.com