বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ০৪:৩৫ পূর্বাহ্ন
Title :
চীনা কোম্পানির বিক্রি বেড়েছে ২১ শতাংশ, চ্যালেঞ্জের মুখে টেসলা আগামীতে পণ্যভিত্তিক মেলা হবে:বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জের জঙ্গি আস্তানা থেকে বোমা উদ্ধার যুক্তরাজ্যে নির্বাচন ঘিরে আশাবাদী অভিবাসী ভোটাররা ঘুমের কারণে ভারত ম্যাচ মিস করেন তাসকিন, চেয়েছেন ক্ষমা ভারতে নতুন আইন কার্যকর:শিশু ধর্ষণে মৃত্যুদণ্ড, বিয়ের আশ্বাসে যৌন সম্পর্কে ১০ বছরের সাজা পেনাল্টি মিস করে শিশুর মতো কান্না রোনালদোর, কাঁদলেন মা-ও ভারতে মোদী সরকারের নতুন ৩ আইন নিয়ে এত বিতর্ক কেন? শিক্ষকদের প্রত্যয় স্কিম বাতিলের আন্দোলন অযৌক্তিক:অর্থমন্ত্রী কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের শাহবাগ অবরোধ

এনআরবিসি ব্যাংকে সুশাসন নেই

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২
  • ২৫ Time View

আইন লঙ্ঘন করে জনবল নিয়োগ, পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে বিধিবহির্ভূত সেবা গ্রহণ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের অনৈতিক সুবিধা নেয়াসহ নানাবিধ বেআইনি কাজে জড়িয়ে পড়েছে বেসরকারি খাতের এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (এনআরবিসি)।

আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তথ্য গোপন করে এসব বেআইনি কাজে প্রত্যক্ষ সহায়তা করেছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। ব্যাংকটির কর্তাব্যক্তিদের এমন কর্মকাণ্ডকে ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে উদ্বেগজনক, অনৈতিক এবং ব্যাংকিং সুশাসনের পরিপন্থী কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শক দল। এ সংক্রান্ত একটি গোপন প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

একাধিক উদ্যোক্তা-পরিচালকের দাখিল করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত দল ১৫ কর্মদিবস পরিদর্শন কার্যক্রম চালিয়ে এ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে বেড়িয়ে এসেছে বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পদে অনভিজ্ঞ লোক নিয়োগ, কোম্পানি বানিয়ে নিজেরাই  নিজেদের সাথে ব্যবসা করা ও দরপত্র ছাড়াই কেনাকাটার মতো কাণ্ড ঘটানোর তথ্য।

এতে দেখা যায়, ‘এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড’ নামে আলাদা কোম্পানি গড়ে নিজেদের ব্যাংকের সঙ্গে নিয়োগসহ ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে এনআরবিসি ব্যাংকের ৯ জন পরিচালক। আর তাদের নেতৃত্বে ছিলেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও গোলাম আউলিয়া এসব অনিয়মের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গোপন রেখেছেন এবং অনুমোদন দিয়ে সুবিধাভোগী হয়েছেন।

পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত এনআরবিসি ব্যাংকের ৬৩ ও ৬৬তম পর্ষদ সভায় লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) ফরহাদ সরকার, মেজর (অব.) মো. পারভেজ হোসেনসহ মোট তিনজন  অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে ব্যাংকটির ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) পদে নিয়োগ দেয়া হয়।

ব্যাংকের নীতিমালায় এ ধরনের পদে নিয়োগের জন্য কমপক্ষে ১৩ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতার শর্ত থাকলেও তা লঙ্ঘন করা হয়েছে। অবৈধভাবে নিয়োগের বিষয়টি ব্যাংকের এমডির পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানোর বিধান থাকলেও এমডি বিষয়টি গোপন করেছেন। ফরহাদ সরকার ও পারভেজ হোসেন বর্তমানে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসভিপি) পদে কর্মরত।

এ ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে চেয়ারম্যানের একাধিক অফিস ব্যবহারের তথ্য উঠে আসে পরিদর্শনে। এতে বলা হয়, এনআরবিসি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের একটি অফিস আছে; তা সত্ত্বেও তিনি নিয়মবহির্ভূতভাবে ব্যাংকের গুলশান শাখায় তার আরেকটি অফিস কক্ষ ব্যবহার করছেন। এর জন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দায়ী করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, চেয়ারম্যানকে এ ধরনের সুবিধা দেয়া ব্যাংকের সুশাসনের পরিপন্থী।

পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যবসার মাধ্যমে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের তথ্য বেড়িয়ে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের মার্চে এনআরবিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও গোলাম আউলিয়া ব্যাংকটির পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের কাছ থেকে কর্মকর্তা-কর্মী নিয়োগ ও ক্রয়সংক্রান্ত চুক্তিতে সই করেন।

চুক্তি অনুযায়ী, এনআরবিসি ব্যাংক লিমিটেড দুই বছর এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের কাছ থেকে গার্ড, পিয়নসহ চুক্তিভিত্তিক লোক নেবে। কিন্তু এ ধরনের নিয়োগ এবং ক্রয়ের জন্য কোনো বিজ্ঞপ্তি ও দরপত্র প্রকাশ করা হয়নি। যদিও এনআরবিসি ব্যাংকের ক্রয় ও ব্যয় ব্যবস্থাপনা নীতিমালায় পণ্য বা সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে দরপত্র আহ্বান করার বাধ্যবাধকতা আছে। এ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ নীতিমালা লঙ্ঘন করে পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সেবা নেয়া ব্যাংকের সুশাসনের পরিপন্থী।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ১৬ উদ্যোক্তা-পরিচালকের মধ্যে ৯ জনই এনআরবিসি ব্যাংকের। কিন্তু এনআরবিসি ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের তালিকায় নেই এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড।

জানা গেছে, এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল নিজেই বিশেষ উদ্দেশ্যে গড়ে তোলা এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্বে আছেন। রাজধানীর দিলকুশা রোডের ২ নম্বর হোল্ডিংয়ে হাদি ম্যানশনের আটতলায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মেজর (অব.) এ এইচ এম শফিউল্লাহ। প্রতিষ্ঠানটি সিকিউরিটি সার্ভিস, গাড়ি সার্ভিস, তথ্যপ্রযুক্তি সেবা, ক্যাশ ব্যবস্থাপনা সেবা, কেনাকাটা, ফ্যাসিলিটি ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা সেবা দিয়ে থাকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের (বিআরপিডি) ২০১৫ সালের এক পরিপত্র অনুযায়ী, সহযোগী প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদোন্নতি-সংক্রান্ত কমিটিতে কোনো ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের থাকার সুযোগ নেই।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একই বিভাগের ২০১৩ সালের ১১ নম্বর সার্কুলার অনুসারে, অনুমোদিত চাকরিবিধির আওতায় নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ যাবতীয় প্রশাসনিক কার্যক্রমে ব্যাংক পর্ষদের চেয়ারম্যান বা পরিচালকদের কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট থাকার সুযোগ নেই। কিন্তু এসব জানা সত্ত্বেও এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ ৯ পরিচালক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট নামে কোম্পানি গঠন করেন এবং তারা সবাই প্রতিষ্ঠানটির নিয়োগসহ যাবতীয় কার্যক্রমে সরাসরি জড়িত।

পরিদর্শন প্রতিবেদনে আরও উঠে আসে সার্ভিস চার্জ বৃদ্ধির মাধ্যমে আয় সংকোচনের তথ্য। এতে বলা হয়, চলতি বছরের মে পর্যন্ত ব্যাংকটি ৯৩টি শাখা, ২২০টি উপশাখা, ২৯২টি ভূমি নিবন্ধন উপশাখা, ১৩১টি অংশীদারিত্ব উপশাখা, ১১৬টি বিদ্যুৎ বিল সংগ্রহ বুথ এবং ২৫টি বিআরটিএ বুথ স্থাপন করেছে।

একদিকে ব্যাংকের উপশাখা ও বুথ স্থাপনের সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের মাধ্যমে ব্যাংকটিতে নিয়োগের সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি এনআরবিসি ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডকে দেয়া সার্ভিস চার্জের পরিমাণও বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। এতে এনআরবিসি ব্যাংকের ব্যয় বাড়ানোর মাধ্যমে আয় সংকুচিত করা হয়েছে।

ব্যাংকটির পর্ষদ সভায় বাড়তি ব্যয়ের মাধ্যমে অর্থ অপচয়ের তথ্য পেয়েছে পরিদর্শক দল। তারা প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, বিদ্যমান নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সভায় জনপ্রতি ৩০ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। একে অনভিপ্রেত বলছে তদন্ত দল। একইভাবে পরিচালকদের সভায় অংশগ্রহণের সম্মানীর সর্বোচ্চ সীমা আট হাজার টাকা হলেও ১৩টি সভায় পরিচালকদের ভ্যাটসহ ৯ হাজার ২০০ টাকা করে দেয়া হয়েছে।

এসব বিষয়ে এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও গোলাম আউলিয়া আমার সংবাদের কাছে তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন।

তিনি বলেন, ‘ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা না থাকলেও সরকারি বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণে পদে চাকরির অভিজ্ঞতা বিবেচনায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের ব্যাংকিং কার্যক্রমে দায়িত্ব দেয়া হয়নি। নিরাপত্তা ও এইচআরের মতো বিভাগগুলোতে তাদের কাজে লাগানো হচ্ছে। যেসব বিষয়ে তারা বেশ অভিজ্ঞ।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া এমন নিয়োগ সঠিক হয়নি বলে স্বীকার করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব বিষয়ে আপত্তি তুলেছে সেগুলো শুধরে নিতে আমরা ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছি।’ প্রসঙ্গত, প্রবাসীদের বিনিয়োগে চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে ২০১৩ সালে যাত্রা করে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড। সম্প্রতি ব্যাংকটি একের পর এক অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published.

More News Of This Category